বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে যে “আমার সোনার বাংলা” গানটি রাখা হয়েছে, সেটি প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমবঙ্গের জন্য লেখা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানটি লিখেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্ব বঙ্গ তথা আজকের পশ্চিমবঙ্গের মাটির প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবে, যা আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বাস্তবতা ও অনুভূতির সঙ্গে কোনোমতেই মেলেনা। কিন্তু আমরা কেন এতকাল এই গানকে বাংলাদেশী জাতীয় সংগীত হিসেবে মেনে নিয়েছি? এটা কি আমাদের নিজের জাতির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও পরিচয়ের সত্যিকার প্রতীক? না, বরং এটা একটি নিছক উপনিবেশবাদী ও ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রভাবের অবশিষ্টাংশ। আমরা এই বিদেশি সাংস্কৃতিক ছাপমুক্ত হতে পারিনি, বরং স্বাধীনতার পরেও সেই দখলদারত্বের ছায়ায় পড়ে আছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সংগীত বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।
এখন প্রশ্ন হলো- আমাদের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত কি সত্যিই আমাদের স্বাধীনতার প্রকৃত প্রতীক? নাকি এগুলো এক ধরনের রাজনৈতিক ও ভারতের আধিপত্যের প্রতীক, যা আমাদের জাতির প্রকৃত পরিচয় ও ইতিহাসকে অবজ্ঞা করে? এখন আমি এই প্রশ্ন উঠানোয় অনেকের কাছে তা ‘অপমানজনক’ মনে হতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্রের আসল চাহিদাই হলো স্বচ্ছতা, প্রশ্নবোধ এবং নিজের দেশ ও ইতিহাসের প্রতি সৎ বিচার। আমাদের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা, যা ১৯০৫ সালের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময়ে লেখা হয়েছিল। অর্থাৎ, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার অনেক আগে এটি রচিত। এই সংগীতে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটির কোনো উল্লেখ নেই, বরং ‘বাংলা’ শব্দের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলার আবেগ প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর সময় পরও এই সংগীতই বাংলাদেশে জাতীয় সংগীত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে আমাদের দেশের নাম ও প্রকৃত সংস্কৃতির উল্লেখ নেই। এটা কি স্বতন্ত্র জাতির সাংস্কৃতিক ও জাতীয় পরিচয় সঠিকভাবে প্রতিফলিত করে? এই প্রশ্ন খুব জরুরি।
আর জাতীয় পতাকার কথা বললে বিষয় আরও জটিল। স্বাধীনতার সময়কার মানচিত্রসহ পতাকা পরবর্তীতে বাদ দিয়ে বর্তমান জাতীয় পতাকা তৈরি হয়েছিল ভারতের সাহায্যে। এটি এক ধরনের ভারতীয় আধিপত্য ও প্রভাবের নিদর্শন, যা আজও বহাল আছে। আমাদের অনেক পণ্ডিত, রাজনীতিবিদ ও জনগণ দাবি করেন, এই পতাকা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের আধিপত্যের প্রতীক। যে দলের ইতিহাসে একদলীয় শাসন, বিরোধীদের দমন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবমূল্যায়ন রয়েছে, তাদের পতাকা জাতির পতাকা হিসেবে গ্রহণ করা কতটুকু যৌক্তিক? এখন আসি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথায়। আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগ ও এর শাসনের বিরুদ্ধে যখন কেউ প্রশ্ন তোলে, তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়, বিরোধীদের গোপনে বা প্রকাশ্যে দমন করা হয়, সাংবাদিক ও এক্টিভিস্টরা নিপীড়িত হন। বিএনপি, যে দল দেশের প্রধান বিরোধী দল, তারও রাজনীতিতে তারুণ্য ও প্রগতিশীল চিন্তার অভাব রয়েছে এবং তারা আজ সরকারের মতোই ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রতীক ব্যবহার করে থাকে। এই দুই দল দেশের জনমতের ধারাকে বিভক্ত করেছে এবং জাতীয় চেতনায় বিভ্রাট সৃষ্টি করেছে।
তাই আজকে অনেকেই প্রশ্ন করেন- আমাদের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত কি সত্যিই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক? নাকি এগুলো ভারতীয় প্রভাব, রাজনৈতিক দলীয় স্বার্থ এবং ইতিহাসের বিকৃত রূপ মাত্র? যখন এই প্রশ্ন উঠে, তখন অনেকেই তাদের ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘বিভাজক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু গণতন্ত্রে প্রশ্ন তোলা কেন অপরাধ? মুক্ত আলোচনা ছাড়া গণতন্ত্র অন্ধকারে চলে যায়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যারা সত্যিকার অর্থে কৃতিত্ববান, তাদের নাম লুকানো বা তাদের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান- যাকে আওয়ামীলীগ বাংলাদেশের জাতির পিতা বলে- সে ছিল ভারতের দালাল ও স্বৈরাচার। তার শাসনামলে স্বৈরাচার ও একদলীয় শাসনের দাগ আছে। রাজনীতিতে বিরোধীদের দমন ও বাকস্বাধীনতার সীমাবদ্ধতার জন্য সমালোচিত। আজকের আওয়ামী লীগের শাসনেও এসব পুরনো অভ্যাস বিদ্যমান। বিএনপিও ততটাই দোষী, কারণ তারা ক্ষমতার লোভে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করেছে। আজকের বাংলাদেশে এই তথাকথিত জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সংগীত আসলে আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক নয়, বরং ভারত ও তাদের দালাল শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রতীক। এই পতাকায় আমরা নিজেদের দেখতে পাই না, এই সংগীতে বাংলাদেশ নামটাও নেই! এটি ভারতের দাসত্বের স্বরলিপি। আমাদেরকে যদি স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে হয়, তবে এই প্রতীকগুলো পুড়িয়ে ফেলতে হবে, জাতীয় পতাকা ও সংগীত বদলাতে হবে। আর ভারতীয় এজেন্ট আওয়ামীলীগ সরকার হটিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
একটি জাতির পতাকা ও সংগীত হতে হবে জনগণের হৃদয় থেকে উঠে আসা, শোষণের ছায়া নয় বরং সম্মানের প্রতীক। আজকের বাংলাদেশে আমাদের পতাকা ও সংগীত অনেকের কাছে বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। এগুলোকে আর অন্ধভাবে অনুসরণ করা চলে না। আমাদের প্রয়োজন এমন জাতীয় প্রতীক যা সকল শ্রেণি-পেশা, ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষকে একতাবদ্ধ করতে পারে।
