জরাজীর্ণ ভবনের দোতলায় উঠতেই সামনে পড়ে একরামুল হকের কক্ষটি। কড়া নাড়তেই সামনে আসেন স্ত্রী আয়েশা বেগম। কক্ষের ভেতরে চারটি প্লাস্টিকের চেয়ার ও একটি টেবিল। টেবিলের এক পাশে রক্তমাখা একটি সাদা চশমা। দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশের দেয়ালে হাতে লেখা কিছু স্মৃতিকথা আর প্রশ্ন। বাবার (একরামুল) উদ্দেশে দেয়ালে লেখা প্রশ্নগুলোর জবাব চার বছরেও পায়নি কিশোরী দুই মেয়ে তাহিয়াত হক ও নাহিয়ান হক।
২০১৮ সালের ২৬ মে রাতে কক্সবাজারের টেকনাফে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন তাহিয়াত ও নাহিয়ানের বাবা একরামুল হক। ঘটনার সময় তিনি টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। ১২ বছর ছিলেন টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি।
একরামুলের ‘হত্যাকাণ্ডের’ সময় মেয়েদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন শোনা যায় একটি ফোনকলের রেকর্ডে। সে সময় একরামুলের মুঠোফোনে মেয়ে ফোন করলে রিসিভ হয়ে যায়। তাঁর স্ত্রী আয়েশা বেগমের মুঠোফোনে রেকর্ড হয়ে যায় গুলির শব্দ-শোরগোল। এই অডিও ছড়িয়ে পড়লে ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোচনায় আসে
ঘটনার পর গণমাধ্যমে পাঠানো র্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, একরামুল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও ইয়াবা গডফাদার। তবে পরিবারের দাবি, একরামুল মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন না। টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী এনামুল হক মনে করে একরামুলকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যা করা হয়।
পবিত্র ঈদুল ফিতর প্রায় চলে এসেছে। কেমন আছে একরামুলের পরিবার? মেয়ে দুটোর লেখাপড়ার কী অবস্থা? এসব বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার টেকনাফের খালিয়াপাড়ায় একরামুল হকের পৈতৃক বাড়িতে তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়।আবেগাপ্লুত আয়েশা বেগম বলেন, ‘চার বছর ধরে আমাদের কোনো ঈদ নেই। একরামুল থাকতে দুই মেয়েকে নিয়ে বাজারে গিয়ে নতুন জামাকাপড় কিনে দিতেন।মেয়েদের আবদার পূরণ করতেন। দুই মেয়েকে ঈদের দিন মোটরসাইকেলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। এখন ঈদ এলে আমাদের কষ্ট বাড়ে। করোনার দুই বছর কেটে গেল, এখন রোজা যাচ্ছে, আসছে খুশির ঈদ। কিন্তু আমরা কেমন আছি, কীভাবে কাটছে আমাদের সংসার, কেউ খোঁজ নেয়নি।’
একরামুলের কক্ষে ঢুকলে প্রথমেই চোখ পড়ে মেয়ে তাহিয়াত হকের হাতে লেখা, ‘মানুষ মানুষকে গুলি করে মারে, নির্দোষ মানুষ কেন মরে?’, আরেক জায়গায় লেখা, ‘ভূতকে ভয় লাগে না, মানুষকে ভয় লাগে’, ‘আব্বু তুমি কোথায়? তুমি কি আর জীবিত ফিরে আসবা না? ‘আমাদের আব্বু হত্যার কি কোনো বিচার পাব না?’ দেয়ালের লেখাগুলোর কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি একরামুলের মেয়েরা।
বিচার নিয়ে শঙ্কা
স্বামী ‘হত্যার’ বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন আয়েশা। বললেন, ১২ বছর ধরে একরামুল উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। তাঁর পুরো পরিবার বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত। বিপদে মানুষের পাশে থাকতেন বলেই জনগণ তিনবার তাঁকে কাউন্সিলর বানিয়েছিলেন। মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। অথচ তাঁকে মাদক ব্যবসায়ী অপবাদ দিয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যা করা হলো।
দুই মেয়ে রাতে দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করে বলে জানান আয়েশা। তিনি বলেন, লেখাগুলো মুছেও ফেলা যাচ্ছে না। মেয়েরা বলে, বাবার বিচার না হওয়া পর্যন্ত দেয়ালের লেখা এভাবেই থাকবে। বাইরের লোকজন এলে যেন বুঝতে পারেন, তাদের বাবা পরিস্থিতির শিকার। তিনি বলেন, ‘মেয়েদের বুঝিয়েছি, কান্নাকাটি করে লাভ নেই, বাবা আর ফিরে আসবে না। পড়াশোনায় মন দাও। কিন্তু বাবার স্মৃতি সামনে এলে তারা স্থির থাকতে পারে না। কয়েক দিন পরে ঈদ। বাবাকে নিয়ে মেয়েদের ঈদের স্মৃতি অনেক। কেনাকাটা, ঘোরাঘুরি মেয়েরা ভুলবে কী করে? গত চার বছর ঈদ কেটেছে নির্জন কক্ষে। এবারের ঈদও কাটবে কান্নাকাটি করে।
একরামুল ‘হত্যার’ চার বছর
২৬ মে একরামুল ‘হত্যার’ চার বছর পূর্ণ হচ্ছে। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে আয়েশা বলেন, ‘চার বছরে কেউ আমাদের খোঁজ নিল না। আয়রোজগারের কোনো পথ নেই। মেয়ে দুটোর লেখাপড়া নিয়ে খুবই চিন্তায় আছি।’
বড় মেয়ে তাহিয়াত পড়ছে একাদশ শ্রেণিতে আর নাহিয়ান দশম শ্রেণিতে। বাবার মৃত্যুর পর লেখাপড়ায় তেমন মনোযোগ নেই তাদের। আয়েশা বললেন, দিন যত যাচ্ছে, মেয়েদের কষ্ট তত বাড়ছে। বিচার না পাওয়া পর্যন্ত তাদের কান্না থামবে না। কান্নাই এখন তাদের প্রতিবাদের ভাষা।
আয়েশা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, একরামুল ‘হত্যার’ পর দেশ ও দেশের বাইরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত সরকারিভাবে এর কোনো তদন্ত হয়নি। তখন তাঁরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, মনের দুঃখ বোঝাতে চেয়েছিলেন। দুজন মন্ত্রী আশ্বাসও দিয়েছিলেন, কিন্তু কাজ হয়নি। এখনো প্রহর গুনছেন, কখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন।
প্রথম আলো থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
