দেশে চলতি বছরের প্রথম আট মাসে আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে ১১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে চলতি বছরের আট মাসে মোট ২ হাজার ৬১৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। একই সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে ৭৯ জন, এবং ৩১০টি সহিংসতা ঘটেছে। এই সংখ্যা কেবল পরিসংখ্যান নয়; এটি দেশের নিরাপত্তা ও জনগণের জীবনযাত্রার জন্য সরাসরি হুমকির প্রতিফলন। নির্বাচনের আগেই এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে। জুলাই মাসে অভ্যুত্থান এবং বিতর্কিত পদক্ষেপের কারণে পুলিশ বাহিনী জনরোষের মুখে পড়েছে। থানায় হামলা, অস্ত্র লুট, বিতর্কিত সদস্যদের পলায়ন এই সবকিছুই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে দিয়েছে। সাধারণ অপরাধীরা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সরকারের অকার্যকর পদক্ষেপ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
বিএনপি ও জামায়াতের কর্মকাণ্ডও উদ্বেগের। চলতি বছরে তারা সমন্বিতভাবে সহিংসতা, চাঁদাবাজি এবং স্থানীয় প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কেন্দ্র করে সাধারণ জনগণকে ভয় দেখানো, অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার ও হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে, নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী ছাত্র সংগঠনগুলোর ষড়যন্ত্র দেশকে অস্থির করছে। তারা মব তৈরি করে, হামলা চালিয়ে এবং রাজনৈতিক উস্কানির মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাচ্ছে। এসব ঘটনায় সরকারও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। খাগড়াছড়িতে গণধর্ষণ এবং হত্যার মতো ঘটনা দেশকে সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। এতে তিনজন প্রাণ হারিয়েছে। এ ধরনের ঘটনা শুধু অপরাধীদের নয়, সরকারের দায়িত্বশীলতারও প্রশ্ন তোলে। সরকারের নজরদারি, প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ এবং জনগণকে সঠিক তথ্য প্রদান না করার কারণে এই ধরনের ঘটনা রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে। বিদেশি চ্যানেল বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকরা এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। এভাবে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যেখানে অন্তবর্তীকালীন সরকারও দায় এড়াতে পারছে না।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেবল খুন বা সহিংসতায় সীমাবদ্ধ নয়। দেশের সমতল ও পাহাড়ে অপরাধ, চাঁদাবাজি, লুটপাট ও অশান্তির ঘটনা বাড়ছে। পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী যেমন সীমান্তে সতর্কতা অবলম্বন করছে, তেমনি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও তদন্তেও তাদের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। লুট হওয়া অস্ত্র এবং পলায়নকারী অপরাধীরা নির্বাচনকে ঝুঁকিপূর্ণ করছে। নাগরিকদের নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালিত না হলে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই বিপন্ন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে অন্তবর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের দায়িত্ব নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ করা। কিন্তু রাজনৈতিক দলের প্রভাব, নিজস্ব পক্ষপাত এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবলের ক্ষয় এই দায়িত্ব পূরণে বাধা সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে সাময়িক স্বার্থের জন্য হিংসা ও উস্কানি দেওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে। দেশের নাগরিকরা আশা করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাজনৈতিক চাপ ছাড়া, কঠোর ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে।
পুলিশ দাবি করছে, তারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। অফিসার ও ফোর্সকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে এবং রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ চলছে। কিন্তু বাস্তবতা দেখাচ্ছে, শুধু প্রশিক্ষণ যথেষ্ট নয়। নির্বাচনকালীন সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, নাগরিক অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে, এবং অস্ত্র, সহিংসতা ও চাঁদাবাজি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এই ধরনের সমন্বয় ছাড়া কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলার অবনতির সঙ্গে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র একত্রিত হয়ে জনগণের নিরাপত্তা ও নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিএনপি ও জামায়াতের সহিংসতা, নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও সহযোগীদের ষড়যন্ত্র, এবং অন্তবর্তীকালীন সরকারের অকার্যকর পদক্ষেপ দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সংকটে ফেলছে। আমরা আশা করি, সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত, স্বচ্ছ এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে জনগণ নিরাপদ, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপভোগ করতে পারে।
ছবি: ইন্টারনেট
