CategoriesDemocracyHuman RightsJusticePolitics

জুলাই সনদ: কেন এটি জনগণের চোখে এক রাজনৈতিক আবর্জনা?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে “জুলাই সনদ” এখন এক হাস্যকর অথচ ভয়ঙ্কর প্রতারণার নাম। এটি এমন এক দলিল, যার কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই, কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই, এমনকি জনগণের কোনো অংশগ্রহণও নেই। অথচ এই তথাকথিত সনদের আড়ালে অন্তবর্তীকালীন সরকার, বিএনপি ও জামায়াত একটি নতুন রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগাভাগির খেলা শুরু করেছে যার মূল লক্ষ্য গণতন্ত্র নয়, বরং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করা।অন্তবর্তীকালীন সরকার, যাদের কাজ ছিল দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, অবাধ নির্বাচন আয়োজন ও প্রশাসন পুনর্গঠন তারা এখন নিজেদের সীমা ছাড়িয়ে একপ্রকার “রাজনৈতিক সালিশি পরিষদ” হয়ে উঠেছে। সংবিধানে এই সরকারের ভূমিকা কেবলই অন্তর্বর্তী প্রশাসনিক; তারা নতুন কোনো রাজনৈতিক চুক্তি তৈরি করতে পারে না। কিন্তু জুলাই সনদে তারা যেন নিজেদের জনগণের ওপরে অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় যেখানে জনগণের মতামত নেই, আছে কেবল কিছু নির্বাচিত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা।

এই সনদের মূল কুশীলব বিএনপি ও জামায়াত, যারা নিজেদের অতীতের ব্যর্থতা ও অপরাধ ভুলিয়ে নতুন করে ক্ষমতার পথে ফিরতে চাইছে। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের “গণতন্ত্র রক্ষার দল” হিসেবে দাবি করলেও বাস্তবে তারা দেশকে যে নৈরাজ্য, দুর্নীতি ও দমননীতির দিকে নিয়ে গিয়েছিল, তা আজও জনগণ ভুলে যায়নি। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের দুঃশাসন, গ্রেনেড হামলা, দমননীতি সব কিছুর দায় তাদের কাঁধে। আজ সেই একই দল “জুলাই সনদ”-এর মাধ্যমে নিজেদের গণতান্ত্রিক রূপে সাজিয়ে তুলতে চায়। অন্যদিকে, জামায়াত যাদের হাতে বাংলাদেশের মাটি রক্তে ভিজেছিল ১৯৭১-এ, যারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির প্রতিনিধি তারাও এখন এই সনদের আড়ালে নিজেদের বৈধতা ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এটি শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং নৈতিক অপরাধও। একটি নিষিদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধে দোষী সংগঠন কীভাবে অন্তবর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে এক টেবিলে বসে “ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রব্যবস্থা” নিয়ে আলোচনা করতে পারে? এটি গণতন্ত্রের জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রের ভিত্তিকে দুর্বল করার জন্য।

জুলাই সনদকে বলা হয়েছে “সংস্কারের চুক্তি”, কিন্তু এটি আসলে দায় এড়ানোর কৌশল। বিএনপি ও জামায়াত উভয়েই জানে, তাদের জনপ্রিয়তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ, মাঠে তাদের অবস্থান দুর্বল, তাই তারা প্রশাসনিক শক্তির ছত্রছায়ায় ফিরে আসার পথ খুঁজছে। অন্তবর্তীকালীন সরকার সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। এর ফলেই এই সনদ তৈরি যেখানে জনগণ একদমই অনুপস্থিত। সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, এই সনদের কোনো আইনি ভিত্তি নেই। এটি কোনো সংসদে গৃহীত নয়, কোনো বিচার বিভাগীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসেনি, এমনকি কোনো গণভোটও হয়নি। অর্থাৎ এটি মূলত কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর তৈরি এক রাজনৈতিক সমঝোতা, যা সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অবৈধ ও অসাংবিধানিক। জনগণের সার্বভৌমত্ব যেখানে সর্বোচ্চ, সেখানে এই সনদ সেই নীতিকেই সরাসরি লঙ্ঘন করেছে।

অন্তবর্তীকালীন সরকারকে জনগণ শুরুতে স্বাগত জানিয়েছিল কারণ মানুষ একটি মুক্ত, নিরপেক্ষ প্রশাসন চেয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, এই সরকারও ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে। তারা আর মধ্যস্থ নয়, বরং খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। তারা বিএনপি ও জামায়াতের মতো ব্যর্থ রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে “পুনর্বাসন” করছে, আর জনগণের কাছে তা বিক্রি করছে “রাজনৈতিক পুনর্গঠন” নামে। বাস্তবে এটি গণতন্ত্র নয় এটি কেবল নতুন এক “রাজনৈতিক চুক্তিভিত্তিক স্বৈরতন্ত্র”। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, জুলাই সনদ গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম নয়, বরং তার মৃত্যুপর্বের সূচনা। কারণ এটি রাজনৈতিক ন্যায়বিচার, আইনের শাসন ও জনগণের অংশগ্রহণ এই তিনটি স্তম্ভকে একসঙ্গে ধ্বংস করেছে। আর এই ধ্বংসের দায় অন্তবর্তীকালীন সরকার, বিএনপি ও জামায়াত তিন পক্ষের সমানভাবে ভাগ।

একটি রাষ্ট্র তখনই টিকে থাকে যখন তার জনগণ রাষ্ট্রব্যবস্থার মালিক হয়। কিন্তু জুলাই সনদ সেই মালিকানাকে কেড়ে নিয়েছে। এটি তৈরি করেছে এক শ্রেণিগত, দলীয় ও গোষ্ঠীগত রাজনীতি যেখানে সত্য ও ন্যায়ের কোনো স্থান নেই, আছে শুধু প্রভাব, সমঝোতা ও সুবিধা। সুতরাং, এই সনদ জনগণের নয় এটি ইতিহাসের আবর্জনা, যা আগামী প্রজন্ম শুধু ঘৃণার সঙ্গে স্মরণ করবে। যদি সত্যিকারের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হয়, তবে এই আইনি ভিত্তিহীন, স্বার্থান্ধ ও অবৈধ জুলাই সনদকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কোনো গোপন চুক্তিতে নয়, বরং জনগণের মুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক মতপ্রকাশে নির্ভরশীল এটাই হোক আজকের রাজনৈতিক চেতনার নতুন প্রতিজ্ঞা।