বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক গভীর দ্বন্দ্বের মুখোমুখি। ১৬ বছর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট শাসন চালু ছিল, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, বিচার ব্যবস্থা, সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন- সবকিছুকে কেবল সরকারের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই দীর্ঘ সময়ে দেশজুড়ে মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছিল, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নিপীড়ন ও স্বাধীন মত প্রকাশের ওপর দমননীতি কার্যকর হয়েছিল। কিন্তু হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন যে দীর্ঘসময় টিকে থাকতে পেরেছিল, তার পেছনে ভারতের নিঃসন্দেহ সমর্থন ও হস্তক্ষেপ অপরিহার্য। ভারতের এই সহায়তা ছাড়া হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসন এত দীর্ঘ সময় স্থায়ী হতে পারত না। এটি স্পষ্ট করেছিল যে, ভারতের স্বার্থ বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের উপরে অবস্থান করছিল। ভারত বাংলাদেশকে এক রাজনৈতিক প্রান্তিকতা ও কৌশলগত সুবিধার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করছেল। ভারতের লক্ষ্য শুধু ভূরাজনৈতিক আধিপত্য অর্জন নয়, তারা চায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নিজেদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করা। ট্রানজিট চুক্তি, সীমান্ত সীমারেখা, পানিসংক্রান্ত বিষয়, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্য all ক্ষেত্রেই তারা বাংলাদেশকে নিজের শোষণমূলক স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। অথচ বাংলাদেশের জনগণ ন্যায্য অধিকার দাবি করলে, সেই দাবি অবহেলা করা হয়েছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করেছিল যে, ভারতের স্বাভাবিক সম্পর্কের ধারণা প্রকৃতপক্ষে একধরনের উপনিবেশী মনোভাবের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
ভারতের প্রকাশ্য ও নিঃসন্দেহ সমর্থন ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা যুগিয়েছিল। তারা জানে, যদি বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। তাই ভারতের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের মাধ্যমে হাসিনাকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলেছে। এই পদক্ষেপ শুধু বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ণ করছে না, বরং জনগণের প্রতি ভারতের স্থায়ী বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণও দেয়। সীমান্ত হত্যা, বাজার নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের স্বার্থহরণ এসব ভারতের নীতির স্পষ্ট প্রমাণ। বাংলাদেশের জনগণ বারবার দেখেছে, ভারত বাংলাদেশের স্বার্থের বিপরীতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। শিক্ষার্থী ও শ্রমিক আন্দোলন দমন করা, তিস্তা চুক্তি প্রতারণা, সীমান্তে হত্যা এসবের মধ্য দিয়ে ভারতের আসল অবস্থান স্পষ্ট। তারা বাংলাদেশের বন্ধু নয়, বরং শোষক প্রতিবেশী।
গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য ভারতের হস্তক্ষেপ ভয়ঙ্কর। বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন সবকিছুকে তাদের স্বার্থমুখী প্রভাবের আওতায় আনা হয়েছিল। দেশের জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের সরকার নির্বাচন করতে চায়, কিন্তু ভারতের পক্ষপাতিত্ব হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনকে শক্তিশালী করছিল। এটি শুধু অভ্যন্তরীণ স্বার্থ লঙ্ঘন নয়; এটি দেশের সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করছিল। গণতন্ত্র রক্ষার জন্য বাংলাদেশে জনগণ বারবার প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু ভারতের সমর্থন থাকায় এই প্রতিবাদ দমন করা হয়েছিল। স্বাধিকার, স্বাধীন মত প্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অধিকার হরণ করা হয়েছিল। এই অবস্থায় স্পষ্ট ভারতের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক তখনই সম্ভব, যখন তারা স্বার্থরক্ষার জন্য নিরপেক্ষ অবস্থান নেবে, হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত দিবে এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে আর সমর্থন করবে না।
ভারত যদি সত্যিই বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, তবে তাদের উচিত বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সম্মান করা, জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা এবং যেকোনো স্বৈরাচারী শাসনকে সমর্থন থেকে বিরত থাকা। অন্যথায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কখনোই স্বাভাবিক হতে পারবে না। গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে এটি জরুরি, যে জনগণ ও দেশের প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ফেরানো ও ভারতের অঙ্গীকারহীন সমর্থন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য ভয়ঙ্কর। দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, জনগণের মৌলিক অধিকার এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য অবিলম্বে প্রয়োজন ভারতের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং স্বৈরাচারী শাসনকে চ্যালেঞ্জ করা। নীরবতা আর গ্রহণযোগ্য নয়; এখনই সময়, যাতে জনগণ ও দেশের প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীভাবে স্বাধিকার রক্ষা করতে পারে।
