২০২৪ সালের আগস্টে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দেশের জনগণ আশা করেছিল যে, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং অনুপ্রাণিত নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা, যা তার শাসনামলের চিহ্ন ছিল, শেষ হবে। তখন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. ইউনুস দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার এবং রাষ্ট্রীয় সহিংসতা বন্ধ করার। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পার হলেও সেই প্রতিশ্রুতি কেবল শূন্য কথাই প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশি মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, আগস্ট ২০২৪ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত ৪০ জনের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মী, গ্রেফতারকৃত নাগরিক এবং সাধারণ মানুষ অন্তর্ভুক্ত, যারা নিরাপত্তা বাহিনীর অপারেশন বা হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রায় ১৫ বছরের শেখ হাসিনার শাসনামলে র্যাব বা Rapid Action Battalion (RAB) এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থা ব্যাপকভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িত ছিল। আশ্চর্যজনকভাবে, ইউনুস সরকারের অধীনে এই একই সংস্থা এখনো কার্যক্রম চালাচ্ছে, কোনো কার্যকর প্রশাসনিক সংস্কার ছাড়াই। অধিকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে মাত্র তিন মাসে ১১ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ১৯ জন “crossfire”-এ নিহত, ১৪ জন গ্রেফতারকালে নির্যাতনের শিকার এবং ৭ জনকে হেফাজতে মারধর করে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনা স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে দায়বদ্ধতার অভাব এখনও বিদ্যমান এবং জনগণ এখনও নিরাপদ নয়।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, COIED-এর রিপোর্ট অনুযায়ী জুলাই ২০২৪ অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী দীর্ঘ সময় ধরে শহরের রাস্তায় মোতায়েন রয়েছে। এই দীর্ঘমেয়াদি মোতায়েন আইনশৃঙ্খলা এবং সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। স্বাধীনভাবে তদন্ত ও বিচার না হওয়ার কারণে জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি আস্থা কমে গেছে। ঢাকা, মিরপুর ও কুমিল্লা-তে যুবক ও সাধারণ নাগরিকদের গ্রেফতারকৃত অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে, যেখানে মৃত্যুর কারণ হিসেবে “unconscious on arrival” বা “crossfire” উল্লেখ করা হয়েছে, যা স্পষ্টভাবে অসঙ্গত এবং নাগরিকদের প্রতি প্রশাসনের নিষ্ঠুরতার প্রমাণ। ড. ইউনুসের সরকার দাবি করলেও যে, তারা স্বচ্ছতা এবং সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, বাস্তবে নিরাপত্তা সংস্থাগুলি পুরনো পদ্ধতি অনুসরণ করছে। পুলিশের নজরদারি, RAB এবং DGFI-এর অপব্যবহার, হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা চলছেই। অনেক ক্ষেত্রে, নিহতদের পরিবারকে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানানো হয়নি, এবং কোনো সুষ্ঠু তদন্ত বা বিচার কার্যকর হয়নি। এতে স্পষ্ট যে, অন্তবর্তীকালীন সরকার কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ হয়েছে এবং জনগণের অধিকার রক্ষা করতে অক্ষম।
নির্বাচন প্রসঙ্গে উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও, নিরাপত্তা বাহিনী এখনো দায়বদ্ধ নয়। নির্বাচন কমিশন ও আদালত পর্যন্ত নিরাপত্তা সংস্থার নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। জনগণের মধ্যে ভয় এবং সংশয় বিরাজ করছে, যা একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। নির্বাচনকালীন সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্বশীলতা এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত না হলে ভোটের ফলাফলও জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে না। অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত ১৭৫২টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এদের মধ্যে এখনও ৩৩০ জন নিখোঁজ। যদিও এই সংখ্যাগুলো পূর্ববর্তী সরকারের তুলনায় কম, কিন্তু নতুন সরকারের দায়িত্ব হলো সেই পুরনো পদ্ধতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং অবিলম্বে কার্যকর সংস্কার করা। তবে, তা হয়নি, তাই নাগরিকরা এখনও অনিরাপদ এবং রাষ্ট্রীয় স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ।
অবশেষে বলা যায়, ড. ইউনুসের অন্তবর্তীকালীন সরকার এখনও জনগণের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ। প্রতিশ্রুতি এবং বাস্তবতার মধ্যে বিস্তর ফাঁক বিদ্যমান। বিদেশি পর্যবেক্ষক, মানবাধিকার সংগঠন এবং সাধারণ জনগণ প্রত্যাশা করেছিল, যে এই সরকার পূর্ববর্তী অতীতের নিপীড়ন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার ধারাকে রোধ করবে। কিন্তু নতুন তথ্য প্রমাণ করছে, সেই প্রতিশ্রুতির চেয়ে বাস্তবতা অনেক পিছিয়ে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও দুর্বল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রভাবশালী রাজনৈতিক আদেশ থেকে মুক্ত নয়। যদি বাংলাদেশের জনগণ সত্যিই একটি নিরাপদ, স্বচ্ছ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, তাহলে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের উচিত অবিলম্বে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা, নির্যাতিত ও নিহতদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা এবং প্রমাণিত অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা। না হলে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হবে এবং গণতন্ত্রের স্বাভাবিক লয় ভঙ্গ হবে।
