বাংলাদেশে রাজনীতির প্রতিটি মোড় আজকাল যেন পূর্বপরিকল্পিত স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী চলে। যখন একটি অবৈধ, ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল, তখন তাদের ভাষা ও লক্ষ্য যেমনটা হয়েছিল—তা স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের জন্ম দেয়। কিন্তু সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হয়, যখন সেই একই ভাষা মিলে যায় দেশের সেনাপ্রধান ও ভারতীয় সেনাপ্রধান,মিডিয়া ও কূটনীতিকদের সুরের সঙ্গে। ডিসেম্বর মাসের মধ্যে বা খুবই দ্রুতই জাতীয় নির্বাচন চাওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগ, সেনাপ্রধান এবং ভারতের বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার চাওয়া একযোগে উচ্চারিত বক্তব্য আজ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও ভাবিয়ে তুলেছে: এদের এত মিল কেন? এরা কি একাট্টা হয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে কিছু সাজিয়ে নিচ্ছে?
সেনাবাহিনী একটি পেশাদার প্রতিষ্ঠান, যার সাংবিধানিক দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নির্বাচন আয়োজন নয়। কিন্তু সম্প্রতি সেনাপ্রধানের একাধিক বক্তব্যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে তিনি “শান্তিপূর্ণ নির্বাচন”, “স্থিতিশীলতা”, এবং “দ্রুত নির্বাচন প্রয়োজন” এজাতীয় কথা বারবার বলছেন। প্রশ্ন হলো, এ ধরনের রাজনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে কেন একজন সেনাপ্রধান কথা বলছেন? জনগণ কি তাকে এজন্য দায়িত্ব দিয়েছে? নাকি তিনি পরোক্ষভাবে একটি দল ও অন্য একটি দেশের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন?
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার যেভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজেদের রক্ষায় ব্যবহার করেছিল, তাতে প্রশাসন, পুলিশ, আদালত এমনকি নির্বাচন কমিশনও প্রায় সর্বাংশে পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সেনাপ্রধান ও ভারতের কথাবার্তাও সেই একই ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। তারা জানে যে আগামী দিনে জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর গণহত্যার বিচার হতে চলেছে। বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, নিপীড়িত হয়েছেন, আর ইতিহাস এই হত্যাকাণ্ডকে কখনো ভুলবে না। ফ্যাসিস্ট সরকার জানে, এই বিচার শুরু হলে তাদের শাসনযুগের নৃশংসতা ও অপরাধগুলো সামনে আসবে এবং জনগণ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ করবে। তাই তারা তাড়াতাড়ি নির্বাচন আয়োজন করে এই বিচার প্রক্রিয়াকে বানচাল করতে চায়, যেন তাদের অপরাধ অপ্রকাশিত থেকে যায়।
ভারত বহু বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নামে হাসিনার একদলীয় শাসনকে অঘোষিত সমর্থন দিয়ে আসছিল। এবারও তারা চাইছে, দ্রুতই নির্বাচন হোক, যেন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার বা তাদের পছন্দের কোন সরকার আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় আসে। এই অবস্থায় যখন সেনাপ্রধানের বক্তব্যও ভারতের অবস্থানের সঙ্গে মিলে যায়, তখন জনগণের মনে প্রশ্ন জাগে — সেনাবাহিনী কি এখন নিজের অভ্যন্তরীণ দায়িত্ব ভুলে গিয়ে বিদেশি প্রভাবের তাবেদারিতে ঢুকে পড়ছে? একজন সেনাপ্রধানের উচিত নিরপেক্ষ থাকা, জনগণের পাশে থাকা। কিন্তু নির্বাচনী প্রশ্নে তার এতো আগ্রহ, এই ভাষাগত মিল, এই সময়সূচির ওপর জোর—সবকিছু মিলিয়ে স্পষ্ট হয় যে, আজ সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্ব নিরপেক্ষতার আবরণ হারাতে বসেছে। এটি শুধু রাজনৈতিক ভারসাম্য নয়, বরং সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তির জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর।
বাংলাদেশের জনগণ আজ একটি নিরপেক্ষ, পেশাদার ও দায়িত্বশীল সেনাবাহিনী চায়—যারা রাজনীতির হাতিয়ার হবে না। ডিসেম্বর নির্বাচন হোক বা অন্য কোনো তারিখে, তা নির্ধারণের দায়িত্ব জনগণের, রাজনৈতিক দলগুলোর এবং সরকারের—not someone in uniform। সেনাপ্রধান যদি সত্যিই দেশের স্থিতিশীলতা চান, তাহলে তার উচিত হবে রাজনীতির বাইরে থেকে বাহিনীকে পেশাদারভাবে পরিচালনা করা, ক্ষমতাসীন দলের সুরে সুর মেলানো নয়। জনগণ এখন সজাগ—তারা বুঝে ফেলেছে কে কার পক্ষে কাজ করছে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না, আর জনগণ কখনও সব ভুলে যায় না।
